فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ
অর্থ:
“তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং (পশু) কোরবানি কর”
[সূরা কাউছার: ২]
যথা:
অনেক আলেমের মতে কোরবানি সুন্নাত। তাঁরা নীচের হাদীসটির মাধ্যমে দলিল পেশ করে থাকেন। নবীপত্নী উম্মে সালামা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন-
إِذَا رَأَيْتُمْ هِلاَلَ ذِي الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ فَلْيُمْسِكْ عَنْشَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ
অর্থ:
যখন তোমরা যিলহজের চাঁদ দেখবে এবং তোমাদের কেউ কোরবানি করার ইচ্ছা করবে, তখন সে যেন চুল, নখ ইত্যাদি কাটা বন্ধ রাখে।
[মুসলিম: হাদীস - ৫২৩৪]
এই হাদীস ইঙ্গিত করে যে, কোরবানি মানুষের ইচ্ছাধীন। ইচ্ছা হলে করবে; না হলে করবে না। বেশির ভাগ হানাফী আলেমের মতে কোরবানি ওয়াজিব। এই দাবির প্রথম দলিল হচ্ছে কুরআন মাজীদের আয়াত। আল্লাহ তায়ালা সূরা কাউসারে বলেছেন-
إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
অর্থ:
আমি তোমাকে কাউসার দান করেছি, সুতরাং তুমি তোমার রবের জন্যে নামাজ পড়ো এবং কোরবানি করো।
[সূরা কাউসার: ১,২]
কোরবানির কথা বলতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা এখানে আদেশসূচক বাক্য ব্যবহার করেছেন। কুরআনের নীতি অনুসারে উন্মুক্ত প্রেক্ষাপটে এমন বাক্য বাধ্যবাধকতার অর্থ প্রদান করে। সুতরাং কোরবানি ওয়াজিব হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া বিভিন্ন হাদীসের ভাষ্যও উল্লিখিত মর্মকে সুদৃঢ় করে। একটি হাদীসে আছে, আবু হোরায়রা (রা) বর্ণনা করেন-
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ وَجَدَ سَعَةٌ فَلَمْ يُضَحٌ فَلَايَقْرُبَنَّ مُصَلَّانَا
অর্থ:
রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, সামর্থ্য থাকার পরও যে ব্যক্তি কোরবানি করবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে-কাছেও না আসে।
[মুসনাদে আহমদ: হাদীস -৮২৭৩]
এই হাদীসে নবী আলাইহিস সালাম সামর্থ্য থাকার পরও কোরবানি বর্জনকারীদেরকে সতর্ক করেছেন। আর সতর্ক করা হয় সাধারণত ওয়াজিব কাজ বর্জন করার ওপর। সুতরাং এই হাদীস কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার বিষয়টিকে সুদৃঢ় করে।
আল্লাহ তা‘আলা কোরআনে বলেছেন :
وَ اتۡلُ عَلَیۡهِمۡ نَبَاَ ابۡنَیۡ اٰدَمَ بِالۡحَقِّ ۘ اِذۡ قَرَّبَا قُرۡبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنۡ اَحَدِهِمَا وَ لَمۡ یُتَقَبَّلۡ مِنَ الۡاٰخَرِ ؕ قَالَ لَاَقۡتُلَنَّکَ ؕ قَالَ اِنَّمَا یَتَقَبَّلُ اللّٰهُ مِنَ الۡمُتَّقِیۡنَ
অর্থ:
আদমের দুই পুত্রের (হাবীল ও ক্বাবীলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শোনাও, যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হল এবং অন্য জনের কোরবানি কবুল হল না। (তাদের একজন) বলল, ‘আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব।’ (অপরজন) বলল, ‘আল্লাহ তো সংযমীদের কোরবানিই কবুল করে থাকেন।
[সূরা মায়েদা -২৭]
আদম ও হাওয়া (আ)-কে দুনিয়াতে পাঠানোর পর আল্লাহ তায়ালা তাঁদেরকে প্রত্যেক গর্ভে দু'জন করে সন্তান দিতেন। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। প্রত্যেক গর্ভের সন্তান দু'জনকে সহোদর সাব্যস্ত করা হতো। এজন্যে তাদের মাঝে বিবাহ বৈধ ছিল না। তাদের বিবাহের নিয়ম ছিল এই যে, এক গর্ভের ছেলের সাথে অপর গর্ভের মেয়ের বিয়ে হতো। এভাবে চলছিল অনেক দিন। এক সময় পরপর দুই জোড়া সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এক জোড়ার ছেলের নাম ছিল হাবিল। অপর জোড়ার ছেলের নাম ছিল কাবিল। নিয়ম অনুযায়ী হাবিল বিয়ে করার কথা ছিল কাবিলের সহোদরাকে এবং কাবিলের বিয়ে করার কথা ছিল হাবিলের সহোদরাকে। কিন্তু হাবিলের সহোদরা মেয়েটি কালো এবং দেখতে অসুন্দর ছিল, আর কাবিলের সহোদরা মেয়েটি ছিল গোরা ও সুশ্রী। কাবিল হাবিলের সহোদরা মেয়েটিকে বিয়ে করার ব্যাপারে পিতা আদম (আ)-এর কাছে আপত্তি করল। সে নিজের সহোদরাকে বিয়ে করার জন্যে গোঁ ধরল। আদম (আ) সমাধান করার জন্যে হাবিল ও কাবিল দুই ছেলেকে বললেন, তোমরা কোরবানি করো। যার কোরবানি আল্লাহ কবুল করবেন, সে সুশ্রী মেয়েটিকে বিয়ে করবে। হাবিল ছিল পশুপালক। তার ভেড়ার পাল ছিল। সে একটি নাদুশনুদুশ ভেড়া কোরবানির জন্যে নির্বাচন করল। কাবিল ছিল কৃষক। সে কৃষিকাজ করতো। কোরবানি করার জন্যে সে কিছু নিম্নমানের শস্য নির্ধারণ করল। তৎকালীন যুগের কোরবানি আমাদের যুগের মতো ছিল না। তখনকার কোরবানি নির্দিষ্ট পাহাড়ে রেখে আসতে হতো। এরপর আসমান থেকে কোনো আগুন আসত এবং গ্রহণযোগ্য কোরবানিকে ভষ্ম করে দিত। কোরবানি ভষ্ম করার জন্যে আসমান থেকে আগুন না এলে সেটা কবুল হয়নি বলে নিশ্চিত হয়ে যেত। হাবিল ও কাবিল দু'জনই নিজ নিজ কোরবানি পাহাড়ের নির্দিষ্ট স্থানে রেখে এল। আসমান থেকে আগুন এসে হাবিলের কোরবানিকে ভষ্ম করে দিল; কিন্তু কাবিলের কোরবানিকে ভষ্ম করে দেওয়ার জন্যে কোনো আগুন এল না। হাবিলের কোরবানি কবুল হওয়ার কারণে কাবিলের সহোদরা সুশ্রী মেয়েটির বিবাহ হাবিলের সাথে হওয়া নিশ্চিত হয়ে গেল। এতে বিগড়ে গেল কাবিল। বিগড়ে গিয়ে কী করল, সে কথা কুরআন মাজীদ বর্ণনা করেছে-
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ. لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ. إِنِّي أُرِيدُ أَنْ تَبُوءَ بِإِثْمِي وَإِثْمِكَ فَتَكُونَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ وَذَلِكَ جَزَاءُ الظَّالِمِينَ. فَطَوَّع
অর্থ:
(হে নবী!) আদমের দুই পুত্রের গল্প যথাযথভাবে এদেরকে শুনিয়ে দাও। যখন তারা দু'জনই কোরবানি করল, তখন তাদের মধ্য থেকে একজনের কোরবানি কবুল করা হলো; আরেক জনেরটা কবুল করা হলো না। (যার কোরবানি কবুল হয়নি) সে বলল, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। (যার কোরবানি কবুল হয়েছিল) সে বলল, আল্লাহ তো শুধু মুত্তাকী লোকদের কাছ থেকে কবুল করে থাকেন। আমাকে হত্যা করার জন্যে যদি তুমি আমার দিকে হাত বাড়াও, তাহলে আমি (কিন্তু) তোমাকে হত্যা করার জন্যে হাত বাড়াব না। কেননা, রাব্বুল আলামীন আল্লাহকে আমি ভয় করি। আমি চাই, তুমি আমার গুনাহ এবং তোমার গুনাহ একাই নিজের মাথায় বহন কর। এরপর তুমি জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হও। আর এটাই জালেমদের প্রতিদান। শেষ পর্যন্ত তার কুপ্রবৃত্তি তাকে আপন ভাইকে হত্যা করার জন্যে উস্কে দিল। অতঃপর সে তাকে হত্যা করেই বসল এবং (এই কাজের মাধ্যমে) সে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত হয়ে গেল।
[সূরা মায়িদা: ২৭-৩০]
এটা কোরবানির প্রথম ইতিহাস হলেও আমাদের কোরবানি এই ঘটনার অনুসরণে নয়। আমরা কোরবানি করে থাকি ইব্রাহীম (আঃ)-এর অনুসরণে। সেই ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। চলুন, কোরবানির বিস্তারিত মাসয়ালা-মাসায়েল আলোচনার আগে সংক্ষেপে সেই ইতিহাসটা জানতে চেষ্টা করি।
আল্লাহ তা‘আলা কোরআনে বলেছেন :
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعۡیَ قَالَ یٰبُنَیَّ اِنِّیۡۤ اَرٰی فِی الۡمَنَامِ اَنِّیۡۤ اَذۡبَحُکَ فَانۡظُرۡ مَاذَا تَرٰی قَالَ یٰۤاَبَتِ افۡعَلۡ مَا تُؤۡمَرُ سَتَجِدُنِیۡۤ اِنۡ شَآءَ اللّٰهُ مِنَ الصّٰبِرِیۡنَ
অর্থ:
অতঃপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে চলা-ফেরার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম (আঃ) তাকে বলল, ‘হে বেটা! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি বল। সে বলল, ‘আব্বা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলরূপে পাবেন।
[সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২]
ইব্রাহীম (আঃ) ছিলেন আল্লাহ তায়ালার বিশিষ্ট নবী ও রাসূল। নবী-রাসূলের জন্যে এক অবধারিত বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আমাদের নবী (আঃ) বলেছেন, আমরা নবী সম্প্রদায় যার যার মর্যাদা অনুসারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যাঁতাকলে নিপতিত হই। ইবরাহীম (আ)-ও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁকেও বিভিন্ন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। তিনি সবগুলো পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন। প্রথম পরীক্ষা ছিল নমরুদের আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া। তিনি সেই আগুনে পড়ে আহ! শব্দটি পর্যন্ত করেননি। প্রথম পরীক্ষার চেয়ে দ্বিতীয় পরীক্ষা হয় আরও কঠিন। ৮৫ বছর বয়স পর্যন্ত ইব্রাহীম (আঃ) নিঃসন্তান জীবনযাপন করতে থাকেন। অনেক কাকুতি-মিনতি আর দোয়া করার পর ৮৬ বছর বয়সে আল্লাহ তাঁকে একটি পুত্র সন্তান দান করেন। কিন্তু সেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে, নবজাতক ও তার মাকে জনমানবহীন ঊষর মরুভূমি মক্কায় নির্বাসন দিয়ে আসতে। ইব্রাহীম (আঃ) সন্তুষ্টচিত্তে এই নির্দেশও পালন করেন। এমন কি নির্বাসন দিয়ে বিদায়কালে মায়ার জালে আবদ্ধ হওয়ার ভয়ে পিছন ফিরে শেষ দেখা থেকেও তিনি বিরত থাকেন। কিছুদিন যাওয়ার পর আসে আরেক নতুন পরীক্ষা। তাঁর সেই ছেলে তখন কিশোর। বয়স ১৩ বছর। ইবরাহীম (আ) পর পর তিনদিন স্বপ্নে দেখেন। তাঁকে বলা হয়, তোমার প্রাণপ্রিয় পুত্রকে কোরবানি করো। নবীদের স্বপ্ন অহীর সমান এবং যথার্থ। এজন্যে ইব্রাহীম (আঃ) 'রেযা বিলকাযা'-এর অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপনের উদ্দেশ্যে হুকুম তামীলের জন্যে প্রস্তুত হয়ে যান। কিন্তু বিষয়টি এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো ছিল না; বরং পরীক্ষার দ্বিতীয় পক্ষ ছিলেন তাঁর ছেলে, যার কোরবানি করতে আদেশ করা হয়েছিল। কাজেই পিতা ছেলেকে স্বপ্নের কথা এবং আল্লাহর হুকুমের কথা শুনিয়ে দেন। ছেলের ভাগ্যেও নবুওয়ত ও রিসালাতের সৌভাগ্যবাণী লেখা ছিল। এজন্যে তিনিও পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যে আনন্দচিত্তে আনুগত্য প্রকাশ করে বলেন, যদি আল্লাহর নির্দেশ এমনই হয়, তাহলে ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। এই আলোচনার পর পিতা ছেলেকে কোরবানি করার জন্যে জঙ্গলের দিকে রওয়ানা হন। জবাই করার জন্যে যেভাবে পশুর হাত-পা বাঁধা হয়, সেভাবে ছেলের হাত-পা বাঁধেন। ছুরিতে ধার দেন। এরপর ছেলেকে উপুড় করে শোয়ায়ে জবাই করতে আরম্ভ করেন। তখন সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা ইব্রাহীম (আঃ) এর ওপর অহী নাযিল করেন। অহীতে বলা হয়, ইব্রাহীম! তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছ। নিশ্চয় এটা জটিল ও কঠিন পরীক্ষা ছিল। এখন ছেলেকে ছেড়ে দাও এবং তোমার পাশে যে দুম্বা দাঁড়িয়ে আছে, সেটা ছেলের পরিবর্তে জবাই করে দাও। আমি এভাবেই নেককারদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। ইব্রাহীম (আঃ) পিছন ফিরে দেখেন, পাশেই একটি দুম্বা দাঁড়িয়ে আছে। আল্লাহর শোকর আদায় করে তিনি সেটা জবাই করে দেন।
এই কোরবানি আল্লাহ তায়ালার দরবারে অত্যন্ত পছন্দ হয়ে যায়। এজন্যে ইবরাহীমি সুন্নাতের স্মৃতি হিসেবে আজও যিলহজ মাসের দশ, এগারো ও বারো তারিখে ইসলামী দুনিয়ায় এই কোরবানি পালন করা হয়।
কুরআনে বর্ণিত কোরবানির ঘটনার এটাই সারকথা। এখানে একটি বিষয় অস্পষ্ট থেকে যায়। তা হলো, জবাইয়ের জন্যে মনোনীত এই ছেলে কে ছিলেন- ইসমাঈল, নাকি ইসহাক?
কুরআন যদিও জবাইয়ের জন্যে মনোনীত সন্তানের নাম উল্লেখ করেনি, কিন্তু কুরআনের বিবরণের ঢং থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যেইব্রাহীম (আঃ)-এর এই সন্তানের নাম ছিল ইসমাঈল। আর এটাই প্রকৃত সত্য। কুরআন মাজীদে এই ঘটনা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে-
رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ فَبَشِّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ، فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللهُ مِنَ الصَّابِرِينَ. فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِيْنِ. وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ. وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ وَتَر
অর্থ:
(ইব্রাহীম আমার কাছে দোয়া করল,) হে আমার রব! তুমি আমাকে একজন নেককার পুত্র সন্তান দান করো। আমি তাকে একজন অত্যন্ত ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহীম বলল, 'বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি। এখন বলো, তোমার অভিমত কী? সে বলল, 'হে পিতা। আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তা-ই করুন, ইনশাআল্লাহ! আপনি দেখবেন, আমি ধৈর্যশীলদের একজন। এরপর দু'জনই যখন আনুগত্যের মাথা নুইয়ে দিল। আর ইবরাহীম তাকে কাত করে শুইয়ে দিল, তখন আমি তাকে ডাক দিলাম, 'হে ইবরাহীম। স্বপ্নে দেখা আদেশ তুমি সত্যে পরিণত করেই ছাড়লে। এভাবেই আমি নেককারদেরকে প্রতিদান দিয়েথাকি। অবশ্যই এটা ছিল একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি এক মহান কোরবানির বিনিময়ে পুত্রটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর আমি তাঁকে পরবর্তীদের মাঝে স্মরণীয় করে রাখলাম। ইবরাহীমের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। নেককারদেরকে আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থথাকি। সে ছিল আমার মুমিন বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। আমি তাকে (আরও) সুসংবাদ দিলাম ইসহাকের (জন্ম ও) নেককারদের অন্তর্ভুক্ত নবী হওয়ার আমি তার ওপর বরকত নাযিল করেছি; বরকত নাযিল করেছি ইসহাকের ওপরও।
[সূরা সাফফাত: ১০০-১১৩]
বিভিন্ন হাদীসে কোরবানির বিভিন্ন প্রকার ফযিলতের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে কয়েকটি হাদীস তুলে ধরছি।
যায়েদ ইবনে আরকাম (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে, তিনি বলেন:
قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ مَا هُذِهِ الأَضَاحِيُّ؟ قَالَ: سُنَّةُ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ. قَالَ قُلْنَا: فَمَا لَنَا فِيهَا؟ قَالَ: بِكُلِّ شَعَرَةٍ حَسَنَةٌ. قَالَ قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ فَالصُّوْفُ قَالَ: بِكُلِّ شَعَرَةٍ مِنَ الصُّوْفِ حَسَنَةٌ
অর্থ:
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই কোরবানি কী? তিনি বললেন, তোমাদের পিতা ইব্রাহীম (আঃ)-এর সুন্নাত। আমরা বললাম, এতে আমাদের জন্যে কী রয়েছে? উত্তরে মহানবী (সাঃ) বললেন, ‘কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমে তোমরা একটি করে নেকি পাবে।’ সাহাবায়ে কেরাম বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমরা যদি ভেড়া কোরবানি করি? ভেড়ার তো অনেক বেশি পশম, এর বিনিময়েও কি আল্লাহ আমাদের সওয়াব দেবেন?’ নবী করিম (সাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর ভান্ডার অফুরন্ত। কেউ যদি তাকওয়ার সঙ্গে আল্লাহর নামে ভেড়া কোরবানি করে, তাহলে তার বিনিময়ে তাকে সে পরিমাণ সওয়াব আল্লাহ অবশ্যই দান করবেন।’
[ বায়হাকী (সুনান): হাদীস- ১৯৪৯০, মুসনাদে আহমদ: ১৯২৮৩]
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে:
قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَا عَمِلَ ابْنُ آدَمَ يَوْمَ النَّحْرِ عَمَلًا أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ هِرَاقَةِ دَم وَإِنَّهُ لَتَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِقُرُونِهَا وَأَخْلَافِهَا وَأَشْعَارِهَا وَأَنَّ الدَّمَ لَيَقَعُ مِنْ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَقَعَ عَلَى الْأَرْضِ فَطِيبُوا بِهَا نَفْسًا
অর্থ:
নবী (আ) বলেছেন, কোরবানির দিনগুলোতে কোরবানির চেয়ে বনী আদমের আর কোনো আমল আল্লাহ তায়ালার কাছে অধিক পছন্দনীয় নয়। কিয়ামতের দিন শিং, ক্ষুর ও পশম সহকারে কোরবানি উপস্থিত হবে। নিশ্চয় রক্ত জমিনে পড়ার আগেই কোরবানি আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে কোরবানি করো।
[তিরমিযী: হাদীস - ১৪৯৩]
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে:
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِفَاطِمَةَ عَلَيْهَا الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ: قُوْمِي
إلى أَضْحِيَّتِكِ فَاشْهَدِيْهَا فَإِنَّ لَكِ بِأَوَّلِ قَطْرَةٍ تَقْطُرُ مِنْ دَمِهَا يُغْفَرُ لَكِ مَا
سَلَفَ مِنْ ذُنُوبِكِ قَالَتْ: يَا رَسُولَ اللهِ هُذَا لَنَا أَهْلِ الْبَيْتِ خَاصَّةً أَوْ لَنَا
অর্থ:
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ফাতেমা (রাঃ)-কে বললেন, তুমি তোমার কোরবানির পশু জবাইয়ের স্থানে উপস্থিত থাকো। কেননা, রক্তের প্রথম ফোঁটা পড়ার সাথে সাথে তোমার পিছনের গুনাহ-খাতা মাফ করে দেওয়া হবে। ফাতেমা (রা) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! বিগত গুনাহ-খাতা মাফ হওয়ার এই মর্যাদা কি আমাদের পরিবারের জন্যে, নাকি আমাদের ও সমস্ত মুসলমানের জন্যে? নবীজি বললেন, আমাদের ও সমস্ত মুসলমানের জন্যে।
[হাকেম (মুস্তাদরাক): হাদীস - ৭৫২৫]
হাসান ইবনে আলী (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে:
مَنْ ضَلَّى طَيِّبَةً بِهَا نَفْسُهُ مُحْتَسِباً لِأُضْحِيَّتِهِ كَانَتْ لَهُ حِجَاباً مِّنَ النَّارِ.
অর্থ:
যে ব্যক্তি আনন্দচিত্তে এবং সাওয়াবের আশায় কোরবানি করবে, কোরবানি তার জন্যে জাহান্নামের পথে প্রতিবন্ধক হবে।
[ তাবারানী (আলমু'জামুল কাবীর): হাদীস - ২৭৩৬]
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে:
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا أُنْفَقَتِ الْوَرِقُ فِي شَيْءٍ أَفْضَلَ مِنْنَخِيرَةٍ فِي يَوْمِ عِيدٍ
অর্থ:
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ঈদের দিন পয়সা খরচ করার জন্যে কোরবানির চেয়ে উত্তম আর কোনো খাত নেই।
[বায়হাকী (সুনান): হাদীস - ১৯৪৮৭]
যে ব্যক্তির মধ্যে নীচের ৬টি শর্ত পাওয়া যায়, তার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়-
[আল ইনায়াহ (শরহুল হেদায়া): ১৪/১৭১, ফাতহুর কাদীর: ২২/৭৩]
[রাদ্দুল মুহতার: ২৬/২৮৭]
[বাদায়ে' সানায়ে': ১০/২৫৬]
মাসয়ালা: কখনও পাগল, কখনও সুস্থ এমন ব্যক্তি যদি কোরবানির দিনগুলোর অধিকাংশ সময় সুস্থ থাকে এবং কোরবানির অন্যান্য শর্তাবলিও তার মধ্যে পাওয়া যায়, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে।
কোরবানির উদ্দেশ্য অবশ্যই সৎ হতে হবে এবং তাতে ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ থাকতে হবে। কোরবানি প্রদর্শন ইচ্ছা ও অহঙ্কারমুক্ত হতে হবে।
অনেকেই বাহবা পাওয়ার জন্য ও আলোচিত ব্যক্তিত্ব হওয়ার লক্ষ্যে লক্ষাধিক টাকার গরু বা উট কিনে লাল ফিতা বেঁধে পথে, পথে ঘোরান।
এটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি কোনো সচ্ছল ব্যক্তির জন্য জীর্ণশীর্ণ কম দামি পশু কোরবানি ও অনুচিত। এ ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর বাণীর দিকেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।
আল্লাহ বলেন- আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এগুলোর গোশ্ত ও রক্ত; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। এভাবেই তিনি সে সবকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর তাকবীর পাঠ করতে পার, এজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন; সুতরাং তুমি সৎকর্মশীলদেরকে সুসংবাদ দাও।
[সূরা হাজ, আয়াতঃ ৩৭]
এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট, উদ্দেশ্যের সততা ও খোদাভীতি কোরবানি কবুলের শর্ত। পশুটি কত বড় ও কত দামের সেটা আল্লাহর কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। বড় ও কত দামের সেটা আল্লাহর কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়।
কোরবানির গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করে তাদের মুখে হাসি ফোটানোও কোরবানির অন্যতম লক্ষ্য।
রাসূল সা: কোরবানির তিন ভাগের এক ভাগ গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করাকে মুস্তাহাব করেছেন। ইচ্ছে হলে এর বেশি; এমনকি সবটাও দান করা বৈধ।
কোরবানির গোশত খাওয়া ও সংরক্ষণ বৈধ, তবে তা করতে গিয়ে কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য 'অন্যের জন্য ত্যাগ' যেন লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকে আমাদের সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
শুধু পশু নয়, পশুত্ব কোরবানি করাও কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার সাথে আমাদের ভেতরের পশুত্বকেও কোরবানি করতে হবে।
আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনে আত্মত্যাগের মহান ইবাদাতের নাম হলো কোরবানি। যে কাজে হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহর বন্ধু হওয়ার জন্য চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতেইকোরবানিির বিধান আমাদের ওপর আরোপিত করা হয়েছে। এ কোরবানি কোনো লোক দেখানো ইবাদাতের নাম নয়।
কুরআন ও হাদিসে কোরবানির বিষয়টি সুস্পষ্ট এবং প্রমাণিত যে, কোনো নেক আমলই আল্লাহ তাআলার নিকট ততক্ষণ পর্যন্ত গৃহীত হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত না তাতে দুটি শর্ত পূরণ করা হয়। কোরবানিও তার ব্যতিক্রম নয়। যা তুলে ধরা হলো-
কোরবানির জন্য প্রয়োজন ইখলাস তথা একনিষ্ঠতা। কোরবানি হবে শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে। নিয়তে পরিশুদ্ধতা না থাকলে কুরবানি কবুল হবে না। দুনিয়ায় প্রথম কোরবানি হাবিল ও কাবিলের মধ্যে অনুষ্ঠিত কোরবানি ।
এতে কাবিলের কোরবানি কবুল হয়নি। কাবিলের কোরবানি কবুল না হওয়া প্রসঙ্গে হাবিল বলেছিলেন, 'আল্লাহ তাআলা মুত্তাক্বিদের (পরহেযগার ও সংযমী) কোরবানিই কবুল করে থাকেন।
[সুরা মায়িদা- ২৭]
কোরবানির একনিষ্ঠতা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, 'আল্লাহর কাছে কখনো ওগুলির (কোরবানির জন্তুর) গোশত পৌঁছে না এবং রক্তও না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া (সংযমশীলতা);
এভাবে তিনি ওগুলিকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এই জন্য যে, তিনি তোমাদেরকে পথ প্রদর্শন করেছেন। আর তুমি সুসংবাদ দাও সৎকর্মশীলদেরকে।
[সুরা হজ - ৩৭]
আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুলের নির্দেশিত বিধান অনুযায়ীই কোরবানি করতে হবে। এ কোরবানিসহ কোনো ইবাদাতেই তাঁর অংশীদার স্থাপন করা যাবে না।
তবেই তাঁর কোরবানিসহ যাবতীয় ইবাদাত কবুল হওয়ার আশা করা যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে,
সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদাতে কাউকে শরিক না করে।
[সুরা কাহফ - ১১০]
পরিশেষে...
যারা শুধুমাত্র বেশি করে গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কোরবানি দেয় অথবা লোক সমাজে সুনাম অর্জনের উদ্দেশ্যে মোটা-তাজা দেখে উচ্চ মূল্যের পশু ক্রয় করে এবং তা প্রদর্শন ও প্রচার করে, তাদের কোরবানি ইবাদত নয়।
আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু যবেহ করা তিন প্রকার হতে পারে-
ঈদুল আযহার দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য যবেহ করাকে কোরবানি বলা হয়।