ঈদের দিন ঈদের নামাজের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু আমল রয়েছে, যেগুলো নবী আলাইহিস সালাম ও তাঁর সাহাবীরা ঈদের দিন গুরুত্বের সাথে আঞ্জাম দিতেন। ইসলামী আইনশাস্ত্রের বিচারে সেগুলোর কোনোটি মুস্তাহাব এবং কোনোটি সুন্নাত। আমরা সেগুলো পর্যাক্রমে আলোচনা করছি।
মিসওয়াক ও গোসল স্বাভাবিক অবস্থায় সুন্নাত। ঈদের দিন এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কেননা, ঈদের নামাজে বহু মানুষের সমাগম হয়। সেখানে পূর্ণ পবিত্র-পরিচ্ছন্ন হয়ে উপস্থিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে-
كَانَ يَغْتَسِلُ يَوْمَ الْفِطْرِ وَيَوْمَ النَّحْرِ
নবী আলাইহিস সালাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন গোসল করতেন।
[নাসবুর রায়াহ: ১/২১৬]
ঈদের দিন নিজের পোশাকাদির মধ্য থেকে উত্তম ও সুন্দরটা পরিধান করা সুন্নাত। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে-
عَن جَعْفَرِ بْنِ مُحَمَّدٍ ، عَنْ أَبِيهِ ، عَنْ جَدِّهِ ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَلْبَسُ بُرْدَ حِبَرَةً فِي كُلِّ عِيدٍ
নবী আলাইহিস সালাম প্রত্যেক ঈদে ডোরাকাটা কাপড় পরিধান করতেন।
[সুনানুল বায়হাকী: হাদীস- ৬৯৩২]
ঈদুল ফিতরের দিন নামাজের উদ্দেশ্যে ঈদগাহে যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে নেওয়া মুস্তাহাব। ঈদুল আযহার দিন এমনটি মুস্তাহাব নয়; বরং কোরবানি হয়ে যাওয়ার পর দিনের প্রথম খাবার হিসেবে কোরবানির
গোশত খাওয়া মুস্তাহাব। একথাও মনে রাখতে হবে যে, শহরাঞ্চলে ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা জায়েয নয়। সুতরাং আগে ঈদুল আযহার নামাজ। তারপর কোরবানি, এবং তারপর সেই কোরবানির গোশত রান্না হলে প্রথম আহার। ঈদুল ফিতরের দিন নামাজের আগে কিছু খাওয়ার ব্যাপারে হাদীসে আছে-
عَنْ أَنَسٍ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَغْدُو يَوْمَ الْفِطْرِحَتَّى يَأْكُلَ تَمَرَاتٍ، وَفِي رِوَايَةٍ وَيَأْكُلُهُنَّ وِتْرًا
আনাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) কয়েকটি খেজুর না খেয়ে ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহের দিকে বের হতেন না। অন্য বর্ণনায় আছে, নবীজি ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার আগে বিজোড় সংখ্যক খেজুর খেয়ে নিতেন।
[সহীহ বুখারী:৯৫৩]
ঈদুল আযহার আমল সম্পর্কে বর্ণিত আছে-
عَنْ بُرَيْدَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ كَانَ يَطْعَمُ يَوْمَ الْفِطْرِ قَبْلَ أَنْ يَخْرُجَ وَكَانَ إِذَا كَانَ يَوْمُ النَّحْرِ لَمْ يَطْعَمْ حَتَّى يَرْجِعَ فَيَأْكُلَ مِنْ ذَبِيحَتِهِ
বুরায়দা (রা) বলেন, ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার আগে রাসূলুল্লাহ (স) আহার করতেন। ঈদুল আযহার দিন এমন করতেন না; বরং ঈদগাহ থেকে ফিরে এসে নিজের কোরবানির গোশত খেতেন।
[সহীহ ইবনে খুযায়মা। হাদীস- ১৪২৬]
ঈদগাহে যাওয়ার সময় এক রাস্তা এবং ঈদের নামাজ শেষ করে অন্য রাস্তায় ঘরে ফেরা মুস্তাহাব। আমার দৃষ্টিতে এর বিশেষ একটি ফায়দা আছে। তা হলো, অনেক মানুষের সাথে সাক্ষাৎ, কুশল বিনিময় এবং দূর-দূরান্তের লোকজনের খোঁজখবর নেওয়া। এভাবে রাস্তা পরিবর্তন সম্পর্কে হাদীসে আছে-
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا كَانَ يَوْمُ عِيدٍ خَالَفَ الطَّرِيقَ
জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) বলেন, নবী আলাইহিস সালাম ঈদের দিন (ঈদগাহ থেকে ফেরার পথে) রাস্তা বদল করতেন।
[সহীহ বুখারী: ৯৮৬]
পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া মুস্তাহাব। ওজর না থাকলে ব্যতিক্রম করা উচিত নয়। প্রচুর যানবাহনের এই যুগে এই মাসয়ালার প্রতি বিশেষভাবে নজর দেওয়া বাঞ্ছনীয়। তাই বলে কোনো রাস্তায় ঝুঁকি নিয়ে পায়ে হাঁটাও উচিত নয়। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা)-এর বর্ণিত হাদীসে আছে-
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ الْفِطْرِ وَيَوْمَ الْأَضْحَى يَخْرُجُمَاشِيًا، وَتُحْمَلُ بَيْنَ يَدَيْهِ الْحَرْبَهُ ، ثُمَّ تُنْصَبُ بَيْنَ يَدَيْهِ فِي الصَّلَاةِيَتَّخِذُهَا سُتْرَةٌ
রাসূলুল্লাহ (স) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যেতেন। তাঁর সামনে একটি বর্শা বহন করে নেওয়া হতো এবং সেটা নামাজের সময় তাঁর সামনে 'সুতরা' হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো।
[বায়হাকী (আস সুনানুল কুবরা) হাদীস - ৬৩৬৪]
অন্য বর্ণনায় আছে, নবী আলাইহিস সালাম ঈদগাহে যেতেন পায়ে হেঁটে, ঈদগাহ থেকে বাড়ি ফিরতেন পায়ে হেঁটে।
ঈদগাহে যাওয়ার পথে উঁচু আওয়াজে তাকবীর বলা সুন্নাত। নাফে (র) বর্ণনা করেছেন যে-
عَنْ نَافِعٍ عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّهُ كَانَ يَخْرُجُ لِلْعِيدَيْنِ مِنَ الْمَسْجِدِ فَيُكَبِّرُ حَتَّى يَأْتِيَ الْمُصَلَّى وَيُكَبِّرُ حَتَّى يَأْتِيَ الإِمَامُ
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) উভয় ঈদের নামাজের জন্যে মসজিদ থেকে বের হতেন। ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত (রাস্তায়) তাকবীর বলতেন। ঈদগাহে পৌঁছেও ইমাম নামাজ আরম্ভ করার আগ পর্যন্ত তিনি তাকবীর বলতেন।
[সুনানে দারাকুতনী: হাদীস- ১৭৩১ ১৪. হাকেম (মুস্তাদরাক): হাদীস- ১১০৭]
ঈদুল ফিতরের তুলনায় ঈদুল আযহায় বেশি করে তাকবীর বলা বাঞ্ছনীয়। আবু আব্দুর রহমান সুলামী (র) থেকে বর্ণিত আছে যে, সাহাবায়ে কেরাম ঈদুল ফিতরের তুলনায় ঈদুল আযহায় অনেক বেশি তাকবীর বলতেন।
[হাকেম (মুস্তাদরাক): হাদীস- ১১০৭]
এই তাকবীরকে তাকবীরে তাশরীক বলা হয়। তাকবীরটি হচ্ছে-
اللهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ وَلِلَّهِ الْحَمْدُ
বড়রা ঈদগাহে যাওয়ার সময় ছোটদেরকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। এটাও একটি মুস্তাহাব আমল। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর বর্ণিত হাদীসে আছে-
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْرُجُ فِي الْعِيدَيْنِ مَعَ الْفَضْلِ بْنِ الْعَبَّاسِ وَعَبْدِ اللهِ وَالْعَبَّاسِ، وَعَلِيٌّ وَجَعْفَرٍ، وَالْحَسَنِ، وَالْحُسَيْنِ، وَأَسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ، وَزَيْدِ بْنِ حَارِثَةَ، وَأَيْمَنَ بْنِ أُمَّ أَيْمَنَ رَافِعًا صَوْتَهُ بِالنَّهْلِيلِ وَالتَّكْبِيرِ فَيَأْخُذُ طَرِيقَ الْحَدَّادِينَ حَتَّى يَأْتِيَ الْمُصَلَّى، فَإِذَا فَرَغَ رَجَعَ عَلَى
রাসূলুল্লাহ (স) দুই ঈদের দিন (ঈদগাহের উদ্দেশে) বের হতেন ফযল ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ, আব্বাস, আলী, জাফর, হাসান, হোসাইন, উসামা ইবনে যায়েদ, যায়েদ ইবনে হারেসা ও উম্মে আয়মানের ছেলে আয়মানকে সঙ্গে নিয়ে। উঁচু আওয়াজে তাকবীর বলতে বলতে কামারদের রাস্তা ধরে তিনি ঈদগাহে যেতেন এবং নামাজ থেকে ফারেগ হওয়ার পর বাড়ি আসতেন মুচিদের রাস্তা দিয়ে।
[সহীহ ইবনে খুযায়মা: হাদীস- ১৪৩১