কোরবানির কোনো কাযা নেই। যদি কোরবানির দিনগুলো অতিবাহিত হয়ে যায় এবং অজ্ঞতা, গাফলত অথবা ওজরের কারণে কোরবানি করতে না পারে, তাহলে কোরবানির মূল্য গরিবদের মধ্যে সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব। তবে কোরবানির তিন দিনের মধ্যে পশুর মূল্য সদকা করলে ওয়াজিব আদায় হবে না; বরং কোরবানি না করার গুনাহ থেকে যাবে। কোরবানির দিনগুলোতে কোরবানির জন্যেই চেষ্টা করতে হবে। যদি সম্ভব না হয় এবং কোরবানির দিনসমূহ অতিবাহিত হয়ে যায়, তাহলে মূল্য সদকা করে দিতে হবে। কোরবানি একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। অন্য কোনো ইবাদত এর বিকল্প হতে পারে না। যেমন- নামাজ পড়লে রোজা এবং রোজা রাখলে নামাজ আদায় হয় না। এমনিভাবে সদকা দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না। অনেক হাদীস এবং সাহাবায়ে কেরামের আমল এর দলিল।
এক ব্যক্তি গত বছর কোরবানি করতে পারেনি। এজন্যে এ বছর যদি কোনো পশুতে দুই অংশ নেয়- এক অংশ গত বছরের, এক অংশ এবারের, তাহলে কোরবানি সহীহ হয়ে যাবে। তবে গত বছরের কোরবানি আদায় হবে না। ঐ অংশ নফল হয়ে যাবে। গত বছরের কোরবানির যিম্মাদারি আদায় করার জন্যে এখন আর কোরবানির রাস্তা নেই। ঐ দায় থেকে মুক্ত হওয়ার একটিই রাস্তা। সেটি হলো, একটি ছাগলের মূল্য সদকা করে দেওয়া।
[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি: ১২৪ (ফাতাওয়া রহীমিয়া: ৩/১৮৬)]
সন্তান জন্মগ্রহণের পর সপ্তম দিনে তার মাথার চুল মুণ্ডানো এবং ছেলের জন্যে দুটি ছাগল আর মেয়ে হলে একটি ছাগল জবাই করে দেওয়াকে আকীকা বলে। হানাফী মাযহাবের আলেমদের মতে আকীকা করা মুস্তাহাব। অন্য মাযহাবের কারো কারো মতে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা এবং কারো কারো মতে ওয়াজিব।
মাসয়ালা : কোরবানির বড় পশুতে শরীক হয়েও আকীকা করা জায়েয। 'এক্ষেত্রে আকীকাতে যেখানে একটি ছাগল জবাই করতে হয়, সেখানে গরু, মহিষ ও উটের এক সপ্তমাংশ গ্রহণ করতে হবে। কাজেই মেয়ের আকীকায় এক-সপ্তমাংশ এবং ছেলের আকীকায় দুই-সপ্তমাংশ আবশ্যক। তবে সামর্থ্যের অভাবে ছেলের আকীকায় গরু-মহিষের এক-সপ্তমাংশ গ্রহণেরও অবকাশ আছে।
মাসয়ালা: শিশুর ভরণপোষণ যার দায়িত্ব, আকীকার যিম্মাও তারই। সুতরাং বাবা আকীকা করে দেবে। বাবার সামর্থ্য না থাকলে দাদা করবে। মায়ের সামর্থ্য থাকলে সেও আকীকা করতে পারবে। এদের কারো সামর্থ্য না থাকলে ঋণ করে আকীকা করার প্রয়োজন নেই। অবশ্য অভিভাবকদের বাইরের কেউ যদি আকীকা করে দেয় এবং অভিভাবকরা তাতে সন্তুষ্ট থাকে, তাহলেও আকীকা হয়ে যাবে। পুনরায় করার প্রয়োজন হবে না।
মাসয়ালা : শুধু জীবিত মানুষের আকীকা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। মৃত সন্তানের আকীকা করার বিষয়টি প্রমাণিত নয়। সুতরাং কোনো সন্তান মরে যাওয়ার পর তার আকীকা করার প্রয়োজন নেই।
মাসয়ালা: কোনো ব্যক্তি বড় হওয়ার পর যদি জানতে পারে যে, মা-বাবা বা অভিভাবক তার আকীকা করেননি, তাহলে সে নিজের আকীকা নিজে করতে পারবে।
মাসয়ালা: কোরবানি বার বার ওয়াজিব হতে পারে এবং ওয়াজিব না হলেও বার বার কোরবানি করার অনুমতি আছে; তবে আকীকা একাধিক বার করার অনুমতি নেই। হাদীস শরীফে একাধিক বার আকীকা করার কথা পাওয়া যায় না। মাসয়ালা: আকীকার গোশতও কোরবানির গোশতের মতো তিন ভাগ করে বিতরণ করা মুস্তাহাব। তবে কেউ যদি ব্যতিক্রম করে, তাহলে কোনো দোষ নেই।
মাসয়ালা: আকীকার গোশত বিনিময় ছাড়া খাওয়ানো বাঞ্ছনীয়। আকীকার গোশত দিয়ে বিয়ের মেহমান খাওয়ানো জায়েয; কিন্তু বিয়ের মেহমানদারি যেহেতু দর কষাকষি করে ঠিক করা হয়, এজন্যে এর মধ্যে বিনিময়ের সন্দেহ থেকে যায়। সুতরাং এমন মেহমানদারিতে আকীকার গোশত
ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা উচিত। তবে যেই দাওয়াতে দর কষাকষির নিয়ম নেই, সেই দাওয়াতে আকীকার গোশত খাওয়ানোর সুযোগ আছে। তা ছাড়া আকীকার গোশত দিয়ে বিয়ে-শাদীর মেহমানদারি করার ক্ষেত্রে সপ্তম দিনে আকীকা করার মুস্তাহাব বাদ পড়ার আশঙ্কাও আছে। এ কারণেও কাজটি ছেড়ে দেওয়া উচিত।
মাসয়ালা : অনেক আলেমের মতে কোরবানির চামড়ার যেই গুরুত্ব, আকীকার চামড়ার সেই গুরুত্ব নেই। তবে আকীকার চামড়াও গরিব- মিসকিনকেই দেওয়া বাঞ্ছনীয়। এর দ্বারা কোনো কাজের বিনিময় দেওয়া উচিত নয়।
ঈদের দিন হচ্ছে আনন্দ ও খুশির দিন। অনেক সময় খুশিতে মানুষ আখেরাতের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে যায়। পক্ষান্তরে কবর যিয়ারত করলে আখেরাতের কথা মনে পড়ে। এজন্যে কোনো ব্যক্তি যদি ঈদের দিন কবর যিয়ারত করে, তাহলে বিষয়টি খুবই উত্তম। এতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে বিষয়টি যদি আবশ্যক করে নেওয়া হয় তাহলে তা আমলগত দিক থেকেই হোক না কেন তখন এটি সঠিক ছাড়া কেউ যদি এই দিনে কবর যিয়ারত না করে, তাহলে তাকে তিরস্কার করা বা তাকে তুচ্ছ করা সঠিক নয়। এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকা অবশ্যক। বিষয়ে সাবধান থাকা আবশ্যক।
নাবালেগ শিশু-কিশোর তদ্রূপ যে সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন নয়, নেসাবের মালিক হলেও তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। অবশ্য তার অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষে কুরবানী করলে তা সহীহ হবে।
[বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১৬]
যে ব্যক্তি কুরবানীর দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে (অর্থাৎ ৪৮ মাইল বা প্রায় ৭৮ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার নিয়তে নিজ এলাকা ত্যাগ করেছে) তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
[ফাতাওয়া কাযীখান৩/৩৪৪, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৫, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৫]
নাবালেগের পক্ষ থেকে কুরবানী দেওয়া অভিভাবকের উপর ওয়াজিব নয়; বরং মুস্তাহাব।
[রদ্দুল মুহতার৬/৩১৫, ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৫]
কুরবানী ওয়াজিব এমন ব্যক্তিও ঋণের টাকা দিয়ে কুরবানী করলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। তবে সুদের উপর ঋণ নিয়ে কুরবানী করা যাবে না।
গর্ভবতী পশু কুরবানী করা জায়েয। জবাইয়ের পর যদি বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায় তাহলে সেটাও জবাই করতে হবে। তবে প্রসবের সময় আসন্ন হলে সে পশু কুরবানী করা মাকরূহ।
[কাযীখান ৩/৩৫০]
দরিদ্র ব্যক্তির উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে যদি কুরবানীর নিয়তে কোনো পশু কিনে তাহলে তা কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
[বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯২]
যদি একটি গরুতে সাত জনের কম ৫/৬ জন শরিক হয় এবং কারো অংশ সাতভাগের কম না হয়; (যেমন, ৭০ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনলে কারো অংশে যেন দশ হাজার টাকা কম না হয়) তবে সবার কোরবানি জায়েজ হবে। আর যদি আট জন অংশীদার হয়, কবে কারো কোরবানি বৈধ হবে না।
যদি কোরবানির পশু হারিয়ে যায় এবং আরেকটি পশু দ্রুত কেনার পর যদি প্রথম পশুটি পাওয়া যায়, এমতাবস্থায় ক্রেতা যদি সম্পদশালী হয়, তবে যে কোনো একটি পশু কোরবানি করা ওয়াজিব হবে। আর যদি লোকটি গরিব হয়, তবে দু'টো পশুই কোরবানি করা তার ওপর ওয়াজিব হবে (যার ওপর কোরবানি ওয়াজিবই হয়নি তার জন্য প্রযোজ্য)।
কোরবানির পশু কেনার পর যদি সেটি বাচ্চা প্রসব করে, তবে ওই বাচ্চাটিকেও কোরবানি করে গরিব মিসকীনদের দিয়ে দেবে, নিজে খাবে না। তবে জবাই না করে সেটি কোনো গরিবকে দান করে দেওয়াও জায়েজ।
সাতজন মিলে অংশীদার হয়ে যদি একটি গরু কোরবানি করে, তবে গোশত নিজেদের ধারণা অনুযায়ী ভাগ করা যাবে না। দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে সমান সমান ভাগ করা উচিত। অন্যথায় যদি ভাগের মধ্যে তারতম্য হয়ে যায়, তবে সুদ হয়ে যাবে এবং গোনাহগার হবে। অবশ্য যদি গোশতের সঙ্গেমাথা, পা বা চামড়াও ভাগ করে দেওয়া হয়, তবে যে ভাগে মাথা, পা, চামড়া থাকবে, সে ভাগে গোশত কম হলেও জায়েজ হবে, যত কমই হোক। কিন্তু যে ভাগে গোশত বেশি সে ভাগে মাথা, পা, বা চামড়া দিলে সুদের মতো হবে এবং গুনাহ হবে।
ছাগলের বয়স পূর্ণ এক বছরের কম হলে জায়েজ হবে না। এক বছর পূর্ণ হলে জায়েজ হবে। গরু, মহিষ দুই বছরের কম হলে কোরবানি জায়েজ হবে না। পূর্ণ দুই বছর হলে জায়েজ হবে। উট পাঁচ বছরের কম হলে জায়েজ হবে না। দুম্বা এবং ভেড়ার হুকুম ছাগলের মতো। কিন্তু ছয় মাসের বেশি বয়সের দুম্বার বাচ্চা এমন মোটাতাজা হয় যে এক বছরের দুম্বার পালে ছেড়ে দিলে সেটিকে আলাদা করে চেনা না যায়, তবে সেই দুম্বার বাচ্চাও কোরবানির জন্য জায়েজ আছে, অন্যথায় নয়। কিন্তু ছাগলের বাচ্চা যদি এরকম মোটা তাজাও হয়, তবুও এক বছর পূর্ণ না হলে কোরবানি জায়েজ হবে না।
যে পশুর চোখ দু'টি অন্ধ, অথবা একটি চোখ পূর্ণ অন্ধ বা একটি চোখের তিনভাগের একভাগ বা আরও বেশি দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে, তবে সে পশুর কোরবানি জায়েজ নয়। এমনিভাবে যে পশুর একটি কানের বা লেজের এক তৃতীয়াংশ বা তার বেশি কেটে গেছে, সেটিও কোরবানির জন্য জায়েজ নয়।
পপশুটি যদি এমন জীর্ণ ও শুকনো হয় যে তার হাড়ের মধ্যের মগজও শুকিয়ে গেছে, তবে এমন পশুর কোরবানি জায়েজ নয়। হাড়ের ভেতরে মগজ যদি না শুকিয়ে থাকে, তবে কোরবানি জায়েজ আছে।
যে পশুর একটি দাঁতও নেই, এমন পশুর কোরবানি জায়েজ হবে না। আর যদি দাঁত পড়ে থাকে এবং অবশিষ্ট দাঁতের সংখ্যা যদি বেশি হয় তবে কোরবানি জায়েজ হবে।
যে পশুর জন্ম থেকে শিং হয়নি কিংবা শিং ছিল, কিন্তু ভেঙে গেছে, তবে এমন পশু দিয়ে কোরবানি জায়েয আছে। অবশ্য যদি একবোরে মূল থেকে ভেঙে যায়, তবে কোরবানি জায়েজ নয়।
যে পশুকে খাসি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে পশু দিয়ে কোরবানি জায়েজ আছে। এমনিভাবে যে পশুর গায়ে বা কাঁধে দাদ বা খুজলি হয়েছে সেটিরও কোরবানি জায়েজ। অবশ্য খুজলির কারণে যদি পশু একবোরেই জীর্ণ হয়ে থাকে, তবে কোরবানি জায়েজ হবে না।
কোরবানির চামড়া এমনিতেই দান করে দেওয়া মুস্তাহাব (ভালো)। কিন্তু যদি চামড়া বিক্রি করে, তবে এর মূল্য হিসেবে প্রাপ্য ওই টাকাটাই গরিবকে দান করতে হবে। ওই টাকা নিজে খরচ করে যদি অন্য টাকা দান করে, তবে আদায় হয়ে যাবে, কিন্তু অনুত্তম হবে।
কোরবানির চামড়ার দাম মসজিদ মেরামত বা অন্য কোনো নেক কাজে খরচ করা জায়েজ নয় বরং গরিবকে দান করতে হবে।
কুরবানীর নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কুরবানীর তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দিন থাকলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে।
[বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২]
যদি বিক্রেতা কুরবানীর পশুর বয়স পূর্ণ হয়েছে বলে স্বীকার করে আর পশুর শরীরের অবস্থা দেখেও তাই মনে হয় তাহলে বিক্রেতার কথার উপর নির্ভর করে পশু কেনা এবং তা দ্বারা কুরবানী করা যাবে।
[আহকামে ঈদুল আযহা, মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ. -৫]
কুরবানীর পশু নিজে জবাই করা উত্তম। নিজে না পারলে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারবে। এক্ষেত্রে কুরবানীদাতা পুরুষ হলে জবাইস্থলে তার উপস্থিত থাকা ভালো।
[মুসনাদে আহমদ ২২৬৫৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২২-২২৩, আলমগীরী ৫/৩০০, ইলাউস সুনান ১৭/২৭১-২৭৪]</
অনেক সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই নিজ নিজ যবাইয়ের আগে 'বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার' পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে তবে ওই কুরবানী সহীহ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না।
[রদ্দুল মুহতার ৬/৩৩৪]
কুরবানীর পশু কেনার পর বা নির্দিষ্ট করার পর তা থেকে উপকৃত হওয়া জায়েয নয়। যেমন হালচাষ করা, আরোহণ করা, পশম কাটা ইত্যাদি। সুতরাং কুরবানীর পশু দ্বারা এসব করা যাবে না। যদি করে তবে পশমের মূল্য, হালচাষের মূল্য ইত্যাদি সদকা করে দিবে।
[মুসনাদে আহমদ ২/১৪৬, নায়লুল আওতার ৩/১৭২, ইলাউস সুনান ১৭/২৭৭, কাযীখান ৩/৩৫৪, আলমগীরী ৫/৩০০
যে পশুর গোশত খাওয়া জায়েয, তার সাতটি জিনিস খাওয়া নাজায়েয-
০১. প্রবহমান রক্ত।
০২. প্রস্রাবের রাস্তা।
০৩. অণ্ডকোষ।
০৪. পায়খানার রাস্তা।
০৫. চামড়া ও গোশতের মাঝে সৃষ্ট গোশতের মত গোটা।
০৬. মূত্রথলি।
০৭. পিত্তথলি।
কুরবানির গোশত নিজে খাওয়া, ধনী মানুষকে হাদিয়া দেওয়া, ফকিরকে সদকা করা এবং অন্য সময় খাওয়ার জন্যে শুকিয়ে রাখা জায়েয আছে।
নাড়ীভুঁড়ি ও ক্ষুরা খাওয়া জায়েয; মাকরূহ নয়।
জবাইকৃত পশুর কাঁচা গোশত খাওয়া জায়েয আছে। পশুর গোশত হালাল হওয়ার জন্যে জবাই জরুরি; কিন্তু রান্না জরুরি না।
পশু জবাই করলে তার নাপাক রক্ত বের হয়ে যায় এবং সাথে সাথে পুরো গোশত পাক হয়ে যায়। সুতরাং গোশত ধোয়া আবশ্যক নয়।
জবাইকৃত পশু হালাল হওয়ার জন্যে জবাইকারীর মুসলমান বা আহলে কিতাব হওয়া শর্ত। এ দুইজন ছাড়া অন্যদের জবাইকৃত পশু হালাল নয়। সুতরাং হিন্দু বা শিখ সম্প্রদায়ের বলি হালাল নয়। মুসলিম ও আহলে কিতাব ছাড়া অন্যদের জবাইকৃত পশু হারাম হওয়ার ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম একমত। সুতরাং অগ্নিপূজক, মূর্তিপূজক, যে কোনো ধরনের মুশরিক, নাস্তিক ও মুরতাদের হাতে জবাইকৃত পশু হারাম।
কুরবানির উদ্দেশ্যে পশু খরিদ করার পর সেটা বিক্রি করা উচিত নয়। যদি কেউ খরিদ করার পর বিক্রি করে এবং কম দাম দিয়ে আরেকটি কেনে, তা হলে যে মুনাফা হবে, সেটাও দান করে দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
[বাদায়ে' সানায়ে': ১০/৩০৯]
দুই ঈদের নামাযে অতিরিক্ত ছয় তাকবীর বলা ওয়াজিব। প্রথম রাকাতে সানার পর সূরা ফাতেহা পড়ার আগে একাধারে তিন তাকবীর বলা, আর দ্বিতীয় রাকাতে কেরাত থেকে ফারেগ হয়ে রুকুতে যাওয়ার আগে তিন তাকবীর বলা ওয়াজিব।
[ফাতাওয়া হিন্দিয়া: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৫০-১৫১, রদ্দুল মুহতার: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৭২-১৭৪]
ঈদের দিন মানুষের নফসের চাহিদা পূরণে, অর্থাৎ খানাপিনা, উত্তম পোশাক- পরিচ্ছদ ও খেলাধুলায় মশগুল হয়ে আল্লাহর মহত্ত্ব, বড়ত্ব, ও শ্রেষ্ঠত্ব ভুলে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। সুতরাং তাদের সতর্কতার জন্য ঈদের নামাযে অধিক তাকবীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যাতে এ কথা স্মরণ থাকে যে, হে আল্লাহ! সকল বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব তোমারই হক। আমরা একান্তই নিঃস্ব।
[আহকামে ইসলাম: পৃষ্ঠা-৮১, ফুতুহাতে মাক্কিয়া: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৫১৮-৫১৯]
ঈদের নামাযে সাহু সেজদা ওয়াজিব হলে সাহু সেজদা করা জরুরী নয়। সাহু সেজদা না করলেও নামায সহীহ হবে।
[ফাতাওয়া হিন্দিয়া: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১২৮, রদ্দুল মুহতার: খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৯২]
যদি ঈদের নামাযে নামাযরত অবস্থায় সূর্য ঢলে পড়ে, তাহলে ঈদের নামায বাতিল হয়ে যাবে। ঈদের নামাযের কাযা নেই।
[তাহতাবী আলা মারাকিল ফালাহ: পৃষ্ঠা-৩২৬-৩২৮, রদ্দুল মুহতার: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৬১০, আল বাহরুর
১. ঈদের দিন ঈদের নামাযের আগে ঘরে, মসজিদে এবং ঈদগাহে নফল পড়া মাকরূহ।
২. ঈদের দিন ঈদের নামাযের আগে মহিলাদের জন্যও ঘরে নফল নামায পড়া মাকরূহ। অবশ্য ঈদের নামাযের পর নারীদের জন্য ঘরে নফল নামায পড়া মাকরূহ নয়।
ঈদের নামাযের ওয়াক্ত সূর্যোদয়ের ১৫ মিনিট পর বা ইশরাকের ওয়াক্ত থেকে শুরু হয়ে সূর্য ঢলে পড়ার আগ পর্যন্ত বাকি থাকে। ঈদুল আযহার নামাধ তাড়াতাড়ি এবং ঈদুল ফিতরের নামায বিলম্বে পড়া মুস্তাহাব।
[আল বাহরুর রায়েক: খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৭১, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৬০, মারাকিল ফালাহ পৃষ্ঠা-৫৩২]
ঈদের দিন ঈদের নামায পড়তে যাওয়ার জন্য এলান বা ঘোষণার যথেষ্ট মাধ্যম রয়েছে। ঈদের দিনে তাকবীর, তাহমীদ ও তাহলীলের বিধান এ উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে, যাতে গাফেল লোকেরা সতর্ক হয়ে যেতে পারে। কাজেই আযান ও ইকামতের বিধান রহিত করা হয়েছে। কেননা, আযান ও ইকামত দেওয়া হয় অসতর্ক লোকদেরকে সতর্ক করার জন্য। বস্তুত ঈদের দিনের এই সতর্কতা বিভিন্নভাবে পূর্ব হতে চলতে থাকে।
[আহকামে ইসলাম পৃষ্ঠা-৮১, ফুতুহাতে মাক্কিয়া: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৫১৮]
ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার নামায সহীহ হওয়ার জন্য জামাত শর্ত। ৩৬৯ জামাত ছাড়া একাকী ঈদের নামায পড়লে নামায সহীহ হবে না। যদি কেউ ঈদের নামায না পায়, তাহলে এর কাযা নেই। তাই ঈদের নামাযের ব্যাপারে অলসতা করবে না।
[ফাতাওয়া হিন্দিয়া: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৫২, রদ্দুল মুহতার খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৭৫, আল বাহরুর রায়েক
অমুসলিম দেশে মুসলমানদের জুমআ এবং ঈদের নামায পড়ার জন্য জায়গার ব্যবস্থা না থাকলে, কোনো হল ভাড়া করে জুমআ এবং ঈদের নামায পড়তে পারবে।
[ফাতাওয়া রাহিমিয়া। খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-১৬৯]
ঈদের নামাযের তাকবীরসমূহে কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে এ কথাই প্রকাশ করা হয় যে, হে আল্লাহ! আমরা আপনার বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের সামনে আমাদের বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বকে বিসর্জন দিলাম, আপনিই সকল বুজুর্গী ও বুলন্দীর মালিক।
[আহকামে ইসলাম: পৃষ্ঠা-৮১, হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা: খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১০, ফুতুহাতে মাক্কিয়া: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৫১৯]
ঈদের দিন ঈদের নামাযের পর মসজিদ এবং ঈদগাহে নফল পড়া মাকরূহ, তবে ঘরে পড়া মাকরূহ নয়। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য একই হুকুম।
[হাশিয়া তাহতাবী আলাল মারাকী পৃষ্ঠা-৫৩১-৫৩২, রদ্দুল মুহতার খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৬৭-১৬৮, আল বাহর
আমাদের দেশের মানুষ ঈদের দিন লাচ্ছা সেমাই, পায়েশ, ফিরনি ইত্যাদি রান্না করা জরুরি মনে করে। শরীয়তের দৃষ্টিতে এসবের কোনো গুরুত্ব নেই। কারো ইচ্ছা হলে কোনো মিষ্টান্ন রান্না করতে পারে, তবে এতে সাওয়াব আছে মনে করা উচিত নয়। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে মিষ্টান্ন পাঠানো, শিশুদেরকে খাওয়ানো, এরপর এগুলো বিনিময় করা এবং সামর্থ্য না থাকলে ঋণ নিয়ে এসবের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি বাধ্যবাধকতা অপচয়ের শামিল। এতে কষ্টও হয়। এজন্যে এগুলো বর্জন করা বাঞ্ছনীয়। কোরবানির ঈদের দিনও এমন বন্দোবস্ত হয়ে থাকে। তাও ভিত্তিহীন। উভয় ঈদের হুকুম অভিন্ন। কোরবানির পশুর নির্দিষ্ট কোনো অংশ কাউকে দেওয়া জরুরি মনে করাও যুক্তিহীন প্রথা। অথচ এমন প্রচলনও কোনো কোনো এলাকায় লক্ষ করা যায়। এগুলো সবই বর্জনীয়।
আজকাল ঈদের সাথে নতুন এক অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে। তা হচ্ছে ঈদ উপলক্ষে গান-বাজনা করা। মুসলমানের জীবন পুরোটা ইবাদত-বন্দেগি দিয়ে পরিবেষ্টিত। এখানে স্বেচ্ছাচারিতার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং ঈদের আনন্দও ইবাদতের মাধ্যমে উদযাপিত হয়। এর অর্থ হচ্ছে মুসলমান ঈদের দিনও ইবাদতে মগ্ন থাকবে। কিন্তু কেউ যদি ইদের দিন মনকে প্রফুল্ল করার জন্যে ইবাদতের বাইরে কিছু করতে চায়, তাহলে সর্বোচ্চ সে মুবাহ কাজ করতে পারে। এই সীমা অতিক্রম করার অনুমতি শরীয়ত প্রদান করেনি।
পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে আয়োজিত গান-বাজনার দিকগুলো নম্বর দিয়ে উল্লেখ করছি-
০১. গান (কবীরা গুনাহ)।
০২. বাজনা (কবীরা গুনাহ)।
০৩. নাচ (কবীরা গুনাহ)।
০৪. নারী-পুরুষের পর্দা লঙ্ঘন (কবীরা গুনাহ)।
০৫. মানুষের ঘুমে বিঘ্ন সৃষ্টি (কবীরা গুনাহ)।
০৬. অসুস্থ ও রোগীদের অস্বস্তি সৃষ্টি (কবীরা গুনাহ)।
০৭. প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া (কবীরা গুনাহ)
০৮. মাদকদ্রব্য সেবন (কবীরা গুনাহ)।
০৯. (সম্ভাবনার ক্ষেত্রে) যেনা (কবীরা গুনাহ)।
১০. নামাজ ছেড়ে দেয়া (কবীরা গুনাহ)।
এখানে অন্যসব প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শুধু গান-বাজনা সম্পর্কে আলোচনা করছি। হাদীস শরীফে গান-বাজনা সম্পর্কে কঠিন হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। আনাস (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে নবী (সা.) বলেন-
صَوْتَانِ مَلْعُونَانِ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ مِزْمَارٌ عِنْدَ نِعْمَةٍ، وَرَنَّةٌ عِنْدَ مُصِيبَةٍ
দুটি আওয়াজ দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত
১. আনন্দের সময় বাঁশির আওয়াজ।
২.দুঃখের সময় চিৎকারের আওয়াজ।
[কানযুল উম্মাল - ৪০৬৭২]
আমাদের দেশের অনেক লোক বিদেশে থাকেন। কেউ চাকরি, কেউ পড়াশোনা, কেউ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। অন্য দেশের লোকজনও আমাদের দেশে একইভাবে অবস্থান করেন। ভিন দেশে মানুষ দুই প্রক্রিয়ায় অবস্থান করেন। ১. কেউ ভিসা/একামা গ্রহণ করে বৈধভাবে থাকেন। ২. কেউ ভিসা/একামা ছাড়া অবৈধভাবে থাকেন। এই উভয় পন্থায় বিদেশে অবস্থানকারীদের ওপর কোরবানির আবশ্যকতা কতটুকু?
কোনো মুসাফির যদি কোনো এলাকায় গিয়ে সেখানে ১৫ দিনের কম অবস্থান করার নিয়ত করে, তাহলে সে মুসাফিরই থেকে যায়; মুকীম হয় না। সুতরাং যে কোনো দেশে গিয়ে যদি কোনো ব্যক্তি ১৫ দিনের কম থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে না। এক্ষেত্রে ভিসা থাকা-না থাকা সমান।
পক্ষান্তরে কোনো দেশে গিয়ে যদি কোনো ব্যক্তি সেখানকার কোনো এলাকায় ১৫ দিন বা তার চেয়ে বেশি থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সে মুকীম হয়ে যাবে। কোরবানির দিনগুলোতে যদি তার কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে। এখানেও ভিসা থাকা-না থাকা সমান
[আল মাবসূত: ১৪/১৬৮]
কনের বাবা, ভাই অথবা অন্য কেউ যদি তার ওয়াজিব কুরবানির পশু বরপক্ষকে জবাই করে খাওয়ার জন্যে প্রদান করে এবং বরপক্ষ উক্ত পশু জবাই করে খায়, তাহলে পশু দানকারীর কুরবানি আদায় হয়ে যাবে। বরপক্ষের কেউ ঐ পশু নিজের কুরবানি আদায়ের নিয়ত করে জবাই করলে তার কুরবানি আদায় হবে না। তবে কনেপক্ষ থেকে যদি কুরবানির নিয়ত ছাড়া কোনো পশু বরকে অথবা বরপক্ষের কাউকে হাদিয়া হিসেবে দান করা হয়, তাহলে সেই ব্যক্তি উক্ত পশু দিয়ে নিজের কুরবানি আদায় করতে পারবে। এমন কি ইচ্ছা হলে সে উক্ত পশু জবাই না করে রেখে দিতেও পারবে।
বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তি যদি মুকীম হয় এবং সে নেসাবের মালিক হয়, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। নিজের তত্ত্বাবধানে কোরবানি করতে কোনো অসুবিধা না থাকলে নিজে কোরবানি করাই উত্তম। নিজের তত্ত্বাবধানে কোরবানি করতে অসুবিধা থাকলে তার অনুমতিসাপেক্ষে তার পিতা অথবা অন্য কেউ কোরবানি করে দিতে পারবে। এটা তার পাঠানো টাকা দিয়েও হতে পারে, অথবা যে কোরবানির ব্যবস্থা করবে, তার কিংবা অন্য কারো টাকা দিয়েও হতে পারে। তবে কোরবানির ব্যবস্থাপক যদি বিদেশরত ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া তার পক্ষ থেকে কোরবানি করে দেয়, তাহলে তার ওয়াজিব কোরবানি আদায় হবে না।
অবশ্য বিদেশে অবস্থানকারী ব্যক্তি যদি প্রতিবছর কোরবানি করার জন্যে টাকা পাঠায়, তাহলে দ্বিতীয় বছর থেকে তার টাকা পাঠানোর কাজটিই অনুমতির দলিল হবে। এজন্যে মৌখিক অনুমতির প্রয়োজন হবে না এবং তার প্রতিনিধি তার পক্ষ থেকে কোরবানি করে দিলে তা সহীহ হবে।
[রাদ্দুল মুহতার: ২৬/২২০]
এখন মানুষ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অর্থ সঞ্চয় করে। সঞ্চয়ের জন্যে অনেক প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। সমবায় সমিতি, ব্যাংক, বীমা ও ডাক বিভাগসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানে আপনি অর্থ সঞ্চয় করতে পারেন। কুরবানির দিনগুলোতে যদি এমন কোনো প্রতিষ্ঠানে কারো নেসাব পরিমাণ সঞ্চয় থাকে, অথবা এ পরিমাণ সঞ্চয় থাকে, যা অন্যান্য হাজাতে আসলিয়ার অতিরিক্ত বিষয়ের সাথে যোগ হয়ে নেসাবকে পূর্ণ করে, তাহলে ঐ ব্যক্তির ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে।
এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ উত্তোলন করতে না পারলেও কুরবানির আবশ্যকতা থেকে যাবে এবং যে কোনো উপায়ে কুরবানির পশু যোগাড় করে কুরবানি করতে হবে।
[রাদ্দুল মুহতার: ২৬/২১১]
ব্যাংক থেকে যে মুনাফা, লাভ বা প্রফিট দেওয়া হয়, তা নিঃসন্দেহে সুদ। কুরআন ও হাদীসের অকাট্য বক্তব্য অনুসারে সুদ হারাম। এমন কি নিকৃষ্টতর হারাম। আর যে কোনো প্রকারের হারাম অর্থ দিয়ে নেক কাজ করাও হারাম। সুতরাং চুরি, ডাকাতি, সুদ, ঘুষসহ যে কোনো ধরনের হারাম পয়সা দিয়ে কুরবানি করা নাজায়েয ও হারাম। ব্যাংকে সঞ্চিত সুদ উত্তোলন করে সাওয়াবের নিয়ত ছাড়া কোনো ফকির-মিসকিন বা মাদরাসার দরিদ্র তহবিলে প্রদান করা বাঞ্ছনীয়।
চাকরিজীবীদেরকে অবসরে যাওয়ার পর সরকার বা কোম্পানীর পক্ষ যে পেনশন বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেওয়া হয়, তা হালাল। এই তহবিল সাধারণত গঠন করা হয়, চাকরিজীবীর আংশিক বেতন কেটে; কর্তিত বেতন সুদে খাটিয়ে এবং সরকার বা কোম্পানীর পক্ষ থেকে কিছু ভর্তুকি দিয়ে। অবসরে গমনকারী চাকরিজীবীর পক্ষে হিসাব করে সুদের পয়সা আলাদা করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া এখানে তার ইচ্ছাও কাজ করে না এবং তারই বেতন কেটে রাখা হয়। সেই বেতন কোনো হালাল খাতে বিনিয়োগ করার সম্ভাবনাও আছে। এজন্যে মুফতী সাহেবদের মতে পেনশন ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ হালাল। আর হালাল মাল দিয়ে কুরবানি জায়েয হওয়ার ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই।
[রাদ্দুল মুহতার। ১৯/৩৭১]
দোকান বা বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় অথবা জমি বন্ধক রাখার সময় মোটা অংকের জামানত দিতে হয়। ভাড়া বা বন্ধক গ্রহণকারী অপর পক্ষকে এই অর্থ দিয়ে থাকে। শরীয়তের দৃষ্টিতে জামানতের এই অর্থ ঋণ হিসেবে গণ্য। আর প্রদত্ত ঋণ যদি নেসাব পরিমাণ হয় এবং কুরবানির দিনগুলোতে পাওয়া যায়, তাহলে কুরবানি ওয়াজিব হবে। আর যদি এই ঋণ নেসাব পরিমাণ না হয় এবং নেসাব হওয়ার মতো অন্য সম্পদও না থাকে, অথবা কুরবানির দিনগুলোতে এই ঋণ ফেরত পাওয়া না যায়, তাহলে ঋণদাতার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে না।
কারো অধিকাংশ সম্পদ যদি হালাল হয় এবং সে নেসাবের মালিক হয়, তাহলে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে। আর যদি কারো অধিকাংশ সম্পদ হারাম হয় এবং সে নেসাবের মালিক হয়, তাহলেও তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে না।
[রাদ্দুল মুহতার ১৯/৩৭১ ১৩৪, ফাতহুল কাদীর ৩/৪৭৫]
পশু খরিদ করার সময় যদি কুরবানির নিয়ত না করা হয়, তাহলেও পরবর্তীতে কুরবানির নিয়তে সেটা জবাই করা যাবে এবং কুরবানিও সহীহ হবে। তা ছাড়া খরিদ করার সময় নিয়ত না করে যদি পরে কুরবানির নিয়ত করে, তাহলে সেটা কুরবানির জন্যে নির্দিষ্ট হবে না। ধনী-গরিব যে কোনো ব্যক্তি উক্ত পশু বাদ দিয়ে অন্য কোনো পশু কুরবানি করতে পারবে।
[বাদায়ে' সানায়ে': ১০/২৬৯ ১৪৬, রাদ্দুল মুহতার: ২৬/২১১]
কোনো ব্যক্তি যদি সরকারের অথবা শত্রুদের কোনো জেল বা হাজতে আটক থাকে এবং সেখানে সে মুকীম ও নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকে, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে। জেল-হাজতে যদি কোরবানি করার মতো পরিবেশ থাকে, তাহলে সেখানে কোরবানি করবে। অন্যথায় তার ওয়ারিশ বা অভিভাবককে ওয়াজিব কোরবানি আদায় করে দেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করবে।
এক ব্যক্তির ওপর একটি কোরবানিই ওয়াজিব হয়। দুটি হয় না। সে যদি কয়েকটি নেসাবের মালিকও হয়, তবুও তার ওপর একটি কোরবানি ওয়াজিব। যেমন- এক ব্যক্তির কাছে সাড়ে সাত তোলা বা তার চেয়ে বেশি স্বর্ণ আছে, সাড়ে বায়ান্ন তোলা বা তার চেয়ে বেশি রুপা আছে এবং কয়েক প্রকারের ব্যবসা আছে, যার প্রত্যেকটিতে নেসাব পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি পুঁজি আছে, তাহলেও এই ব্যক্তির ওপর একটি কোরবানিই ওয়াজিব হবে।
[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি: ৭/১০৬]
কোরবানির পশু খরিদ করার আগেই শরীক নির্দিষ্ট করে নেওয়া হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা। যদি এই নিয়তে খরিদ করে যে, পরবর্তীতে কাউকে পাওয়া গেলে শরীক করে নেবে, তাহলেও জায়েয।
যদি নিয়ত ছাড়া পশু খরিদ করে এবং পরবর্তীতে কয়েক জনকে শরীক করে, তাহলে জায়েয হওয়া-না হওয়ার ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। তবে অগ্রাধিকারযোগ্য অভিমত হলো, জায়েয হবে।
[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি ১০৯ , কেফায়াতুল মুফতী: ৮/১৮৮]
যদি সাত শরীক মিলে একটি গরু কোরবানির উদ্দেশ্যে খরিদ করে এবং কোরবানির আগে একজন দল থেকে আলাদা হয়ে যায়। তারপর তার পরিবর্তে আরেক জনকে শরীক নেওয়া হয়, তাহলে দেখতে হবে দল পরিত্যাগকারী নেসাবের মালিক কি না?
যদি সে নেসাবের মালিক হয়, তাহলে সবার কোরবানি সহীহ হয়ে যাবে। আর যদি সে নেসাবের মালিক না হয়, অর্থাৎ তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব না হয়, তাহলে অন্য শরীকদের কোরবানিও সঠিক হবে না।
[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি: ১১০, কেফায়াতুল মুফতী: ৮/১৯০]
যদি সাতজন শরীক হয়ে একটি গরু কিনে এবং কোরবানির দিন জবাই করে। এরপর একজন এসে বলে, আমাকে শরীক করো। তখন এক শরীক তার কাছ থেকে মূল্য নিয়ে নেয় এবং নিজের অংশ তাকে দিয়ে দেয়, তাহলে জায়েয হবে না। কোরবানি জবাই হয়ে যাওয়ার পর পরিবর্তন জায়েয নয়।
[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি: ১১০, আযীযুল ফাতাওয়া: ১/৭১৯]
সাতজন মিলে গরু কেনার পর জানা গেল, তাদের মধ্য থেকে একজন হচ্ছে কসাই। তার উদ্দেশ্য কোরবানিতে অংশ নিয়ে সেই গোশত বিক্রি করে দেওয়া। তাহলে এই ব্যক্তির অংশ কোরবানির নিয়ত আছে এমন এক ব্যক্তি কিনে নেবে, তারপর কোরবানি করবে; অন্যথায় সবার কোরবানি খারাপ হয়ে যাবে। কারো কোরবানি সঠিক হবে না।
[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি: ১১০, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া: ২/৩১১]
ছয় প্রকার গৃহপালিত পশু দিয়ে কোরবানি করা যায়। এগুলোর মধ্যে তিন প্রকার হচ্ছে বড় এবং তিন প্রকার ছোট। ছোট তিন প্রকার হচ্ছে ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। এগুলো একেকটি শুধু একজনের পক্ষ থেকেই কোরবানি করা যায়। বড় তিন প্রকার হচ্ছে উট, গরু ও মহিষ। একেকটি বড় পশুতে সাতজন পর্যন্ত শরীক হয়ে কোরবানি করতে পারে। বড় পশুতে সাতজন হওয়া জরুরি নয়। সাতের চেয়ে কম শরীক মিলেও বড় পশু কোরবানি করা জায়েয। শরীকরা ছাড়া যদি দুই এক অংশ অবশিষ্ট থেকে যায়, তাহলে সবার সম্মতিক্রমে রাসূলুল্লাহ (স) বা কোনো মৃতব্যক্তির পক্ষ থেকে কোরবানি করে দেয়ার আবকাশ আছে; বরং তা করে দেওয়া মুস্তাহাব। এক্ষেত্রেও শরীকদের মূল অংশগুলো সমান হতে হবে। যদি কোনো প্রকার বেশকম হয়, তাহলে কোরবানি দুরস্ত হবে না।
[বাদায়ে' সানায়ে': ১০/২৭৯, ফাতহুল কাদীর: ২২/৮৭]
মাসয়ালা : বড় পশুতে যেমনিভাবে সাতজন শরীক হওয়া জায়েয, তেমনিভাবে সাতের কম ব্যক্তি মিলেও কোরবানি করা জায়েয। এমনকি সাতের বিভাজন ঠিক রেখে বেশকম অংশ নিয়েও কোরবানি করা জায়েয। যেমন- তিন ব্যক্তি মিলে একটি গরু কোরবানি করবে; কিন্তু তাদের ভাগ হচ্ছে এমন যে, এক ব্যক্তির সাতের তিন অংশ এবং অপর দুই জনের সাতের দুই অংশ করে। এভাবে কোরবানি করলেও জায়েয হবে।
যদি সাতজন মিলে পাঁচটি গরু কোরবানি করে, তাহলেও প্রত্যেকের কোরবানি সহীহ হবে। কেননা, তখন প্রত্যেক শরীকের পক্ষ থেকে প্রতিটি গরুর পাঁচ সপ্তমাংশ কোরবানি করা হবে।
[বাদায়ে' সানায়ে': ১০/২৭৯]
কোরবানির একটি বড় পশুতে কয়েক প্রকার নিয়তে অংশগ্রহণ করার সুযোগ আছে। বিভিন্ন প্রকার নিয়তের অবকাশ থাকলেও শরীকদের অংশ এক- সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না, সে কথা সবসময় মনে রাখতে হবে। নিম্নে নিয়তের ধরনগুলো তুলে ধরা হচ্ছে-
০১. সাধারণ কোরবানি। অর্থাৎ, ধনী মানুষের ওয়াজিব কোরবানি।
০২. মানতের কারণে ওয়াজিব কোরবানি।
০৩. নফল কোরবানি।
০৪. অসিয়তের কোরবানি।
০৫. আকীকা।
০৬. অলিমা।
০৭. হজ পালনে ত্রুটি হলে তার জরিমানা; অর্থাৎ দমে জেনায়াত।
০৮. তামাতু' বা কেরান হজের দমে শোকর।
[বাদায়ে' সানায়ে': ১০/২৮২]
মাসয়ালা : সাত শরীকের মধ্য থেকে একেক জন একেক নিয়ত করলেও সহীহ হবে। যেমন- একজন ওয়াজিব কোরবানি, একজন মানতের কোরবানি, একজন নফল কোরবানি, একজন আকীকা, একজন দমে শোকর ইত্যাদি।
[বাদায়ে' সানায়ে': ১০/২৮২]
কোরবানির উদ্দেশ্যে পশু খরিদ করার পর যদি সেই পশু কোরবানি করার আগেই মারা যায় এবং ক্রেতা গরিব হয়, তাহলে তার কোরবানি রহিত হয়ে যাবে। নতুন করে পশু খরিদ করে কোরবানি করা তার জন্যে ওয়াজিব নয়। আর যদি ক্রেতা ধনী হয়, তাহলে তার কোরবানি রহিত হবে না; আরেকটি পশুর ব্যবস্থা করে কোরবানি করতে হবে।
[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি: ১১৮]
কোরবানির পশু খরিদের পর যদি সেটা হারিয়ে যায় এবং ক্রেতা ধনী ও নেসাবের মালিক হয়, তাহলে আরেকটি পশু যোগাড় করে তাকে কোরবানি করতে হবে। যদি ক্রেতা গরিব হয়, তাহলে আরেকটি পশুর ব্যবস্থা করা তার জন্যে ওয়াজিব নয়; বরং তার কর্তব্য রহিত হয়ে যাবে।
কোরবানির উদ্দেশ্যে খরিদকৃত পশু হারিয়ে যাওয়ার পর ধনী অথবা গরিব লোক যদি আরেকটি পশু কিনে এবং আগেরটিও ফিরে পাওয়া যায়, তা হলে ধনী ব্যক্তির জন্যে একটি পশু কোরবানি করলেই যথেষ্ট হবে। আরেকটি তার জন্যে কোরবানি করে দেওয়া উত্তম। কিন্তু যদি কোরবানি না করে, তাহলে সে গুনাহগার হবে না। অপর পশুটি সে পালনের জন্যে রেখে দিতে পারে। বিক্রি করেও দিতে পারে। জবাই করে গোশতও বিক্রি করতে পারে। মোটকথা, অপর পশুটি সে যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে।
কিন্তু গরিব যদি কোরবানির পশু হারিয়ে যাওয়ার পর আরেকটি কিনে এবং আগেরটিও ফিরে পায়, তাহলে তার দুটোই কোরবানি করা ওয়াজিব। কেননা, গরিব লোক কোরবানির পশু কেনার সাথে সাথে সেটা কোরবানির জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে যায়; কিন্তু ধনী কিনলে সেটা কোরবানির জন্যে নির্দিষ্ট হয় না। কেননা, তার ওপর কোরবানি আগে থেকেই ওয়াজিব।
[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি: ১১৮ ,কেফায়াতুল মুফতী: ৮/২০৩)]
কারো ওপর কোরবানি ওয়াজিব ছিল; কিন্তু কোরবানির তিন দিন অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও কোরবানি করতে পারেনি, তাহলে একটি ছাগল বা ভেড়ার মূল্য সদকা করে দিবে। যদি পশু কিনে থাকে, তাহলে সেই পশুটিই সদকা করে দিবে।
[রাদ্দুল মুহতার: ২৬/২৩৫]
মাসয়ালা : কোরবানির পশু খরিদ করা সত্ত্বেও যদি ঈদের তিন দিনে কোরবানি করতে না পারে, তাহলে ধনী হোক অথবা গরিব, কোরবানি নফল, ওয়াজিব হোক কিংবা মানতের, সর্বাবস্থায় ওই পশু সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব। ১৮৪ যদি মাসয়ালা না জানার কারণে ঈদের তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর উক্ত পশু জবাই করে, তাহলে সেটার গোশত গরিবদের মধ্যে সদকা করে দিবে; কোনো ধনী ব্যক্তিকে এর গোশত দেয়া যাবে না; নিজেও খাওয়া যাবে না।
[রাদ্দুল মুহতার: ২৬/২৩৫]
এক ব্যক্তি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক ছিল। এজন্যে কোরবানির পশু খরিদ করেছে। এখন সে যদি কোরবানির দিন আসার আগে গরিব হয়ে যায় এবং কোরবানির দিনসমূহ থাকতে নেসাব পরিমাণ সম্পদ তার মালিকানায় না আসে, তাহলে তার যিম্মা থেকে কোরবানির হুকুম রহিত হয়ে যাবে। তবুও যদি সে কোরবানি করে, তাহলে নফল হবে। আর ইচ্ছা হলে কোরবানির পশু বিক্রি করে সে অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু কোরবানির দিন থাকতে থাকতে সে যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে যায়, তাহলে পুনরায় তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে। মন চাইলে আগের খরিদকৃত পশুটি কোরবানি করতে পারবে; মন চাইলে নতুন করে খরিদ করেও নিতে পারবে।
যে কোনো ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার জন্যে কিছু শর্ত আছে। কোরবানিও একটি ইবাদত। এই ইবাদতও কবুল হওয়ার জন্যে কিছু শর্ত আছে। শর্তগুলো নিম্নরূপ-
০১. কোরবানি দাতার মুত্তাকী হওয়া।
০২. কোরবানি শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে করা।
০৩. হালাল মাল দ্বারা কোরবানি করা।
০৪. আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী যথাযথভাবে কোরবানি করতে না পারার কারণে অনুতপ্ত হওয়া এবং নিজের অক্ষমতা স্বীকার করা।
০৫. কোরবানি করতে গিয়ে ভুলত্রুটি হওয়ার আশঙ্কায় আল্লাহর পাকড়াওকে ভয় করা।
০৬. লোক দেখানোর অভিপ্রায় যেন কোরবানি বরবাদ করে না দেয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা।
এক ব্যক্তির পাঁচ ছেলে। সবাই প্রাপ্তবয়স্ক, সবাই অর্থ উপার্জন করে পিতার হাতে জমা দেয়। এখানে সবার অর্থ মিলিয়ে একটি নেসাব সাব্যস্ত হবে। যদি সব মিলিয়ে কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার নেসাব পূর্ণ হয়, তাহলে পিতার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে।
পিতার কাছে অর্থ জমা দেওয়া সত্ত্বেও যদি কোনো ছেলে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাহলে তার ওপর আলাদাভাবে কোরবানি ওয়াজিব হবে। অবশ্য পিতা যদি তার অনুমতি নিয়ে কোরবানি করে দেন, তাহলে উক্ত ছেলের কোরবানি আদায় হয়ে যাবে।
মাসয়ালা: পরিবারের কোনো স্ত্রীলোক যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হয়, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। সুতরাং তার পক্ষ থেকে স্বামী বা সন্তানের কোরবানি করে দেওয়া অনাবশ্যক।
[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি: ৭/১০৬]
কোনো পরিবারে এমন কয়েকজন ব্যক্তি থাকে, যারা বালেগ ও নেসাবের মালিক, তাহলে তাদের সবার পক্ষ থেকে একটি ছাগল গরু- মহিষের (সাতের) একাংশ কোরবানি করলে যথেষ্ট হবে না। প্রত্যেকের পক্ষ থেকে আলাদা কোরবানি করতে হবে। প্রত্যেকের পক্ষ থেকে যদি আলাদা আলাদা কোরবানি না করা হয়, তাহলে যাদের পক্ষ থেকে কোরবানি করা হবে না, তারা গুনাহগার হবে।
[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি: ৭/১১৩, ফাতাওয়া রহীমিয়া: ৬/১৬৪]
নিয়ম হচ্ছে, যে ব্যক্তি নেসাবের মালিক, তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। এই ওয়াজিব আদায়ের ব্যবস্থা তার নিজেরই করার কথা এবং উত্তমও তা-ই। কিন্তু নেসাবের মালিক হওয়া সত্ত্বেও কোনো ওজরের কারণে কেউ যদি কোরবানির ব্যবস্থা করতে না পারে, তাহলে সে নিজের পক্ষ থেকে কোরবানি করার জন্যে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেবে। তার অনুমতি নিয়ে অন্য কেউ যদি তার কোরবানি আদায় করে দেয়, তাহলে তার কোরবানি সহীহ হবে। তবে অনুমতি ছাড়া কেউ যদি তার পক্ষ থেকে কোরবানি করে দেয়, তাহলে তার ওয়াজিব কোরবানি আদায় হবে না।
[আল-মাবসূত: ১৪/১৮৪]
চার ভাইয়ের ব্যবসা একসাথে। চারজন সমান অংশের মালিক। যদি এই চারজনের যৌথ সম্পত্তি এতটা মূল্যবান হয় যে, করজ আদায় করে দেওয়ার পর প্রত্যেকের অংশ নেসাব পরিমাণ হবে, তাহলে এই চারজনের মধ্যে যারা বালেগ, তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব। প্রত্যেকের কমপক্ষে একটি ছাগল বা গরু-মহিষের একসপ্তমাংশ কোরবানি করতে হবে।
যৌথ সম্পদের পক্ষ থেকে একটি ছাগল বা গরু-মহিষের একসপ্তমাংশ কোরবানি করে দেওয়া যথেষ্ট নয়। একটি ছাগল যদি দুইজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা হয়, তাহলে কোরবানি ওয়াজিব হোক অথবা নফল- জায়েয হবে না এবং তা কোরবানিও হবে না।
[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি: ৭/১০৫, কেফায়াতুল মুফতী: ৮/১৭৬]
যখন কেউ কুরবানি পেশ করার ইচ্ছা করে আর যিলহজ মাস প্রবেশ করে। তার জন্য চুল, নখ অথবা চামড়ার কোনো অংশ কাটা থেকে বিরত থাকবে, যতক্ষণ না কুরবানি করবে।
হাদিসে এসেছে-
عن أم سلمة رضى الله عنها - أن النبي صلى الله عليه وسلم- قال: « إذا رأيتم هلال ذي الحجة، وأراد أحدكم أن يضحي فليمسك عن شعره وأظفاره». [رواه مسلم] وفي رواية له: « فلا يمس من شعره وبشره شيئا » ، وفي رواية حتى يضحي.
উম্মে সালামাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমাদের মাঝে যে কুরবানি করার ইচ্ছে করে সে যেন যিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। ইমাম মুসলিম হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তার অন্য একটি বর্ণনায় আছে-'সে যেন চুল ও চামড়া থেকে কোনো কিছু স্পর্শ না করে। অন্য বর্ণনায় আছে 'কুরবানির পশু যবেহ করার পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থায় থাকবে।
[মুসলিম: ১৯৭৭]
কুরবানি দাতার পরিবারের লোক জনের নখ, চুল ইত্যাদি কাঁটাতে কোনো সমস্যা নেই।
কোন কুরবানি দাতা যদি তার চুল, নখ অথবা চামড়ার কোনো অংশ কেটে ফেলে তার জন্য উচিৎ তাওবা করা, পুনরাবৃত্তি না করা, তবে এ জন্য কোনো কাফফারা নেই এবং এ জন্য কুরবানিতে কোনো সমস্যা হবে না। আর যদি ভুলে, অথবা না জানার কারণে অথবা অনিচ্ছাসত্বে কোনো চুল পড়ে যায়, তার কোনো গুনাহ হবে না। আর যদি সে কোনো কারণে তা করতে বাধ্য হয়, তাও তার জন্য জায়েয, এ জন্য তার কোনো কিছু প্রদান করতে হবে না। যেমন নখ ভেঙ্গে গেল, ভাঙ্গা নখ তাকে কষ্ট দিচ্ছে সে তা কর্তন করতে পারবে, তদ্রূপ কারো চুল লম্বা হয়ে চোখের উপর চলে আসছে সেও চুল কাটতে পারবে অথবা কোনো চিকিৎসার জন্যও চুল ফেলতে পারবে।
কুরবানি দাতা চুল ও নখ না কাটার নির্দেশে কি হিকমত রয়েছে এ বিষয়ে উলামায়ে কেরাম অনেক কথা বলেছেন। অনেকে বলেছেন: কুরবানি দাতা হজ করার জন্য যারা এহরাম অবস্থায় রয়েছেন তাদের আমলে যেন শরিক হতে পারেন, তাদের সাথে একাত্মতা বজায় রাখতে পারেন।
ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেছেন-
'কুরবানি দাতা চুল ও নখ বড় করে তা যেন পশু কুরবানি করার সাথে সাথে নিজের কিছু অংশ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কুরবানি [ত্যাগ] করায় অভ্যস্ত হতে পারেন এজন্য এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে।' যদি কেউ যিলহজ মাসের প্রথম দিকে কুরবানি করার ইচ্ছা না করে বরং কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর কুরবানির নিয়ত করল সে কি করবে? সে নিয়ত করার পর থেকে কুরবানির পশু যবেহ পর্যন্ত চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকবে।